Foto: Shutterstock

ডিজিটাল প্রভাব অভিবাসী পরিবারে পিতামাতা-সন্তানের দ্বন্দ্বের কারণ হতে পারে

পিতামাতা হিসেবে আমরা সবসময় আশা করি আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভালো করবে এবং পরবর্তীতে তাদের কর্মজীবনে সফল হবে। তবে এই ডিজিটাল যুগে সাফল্যের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে এবং পেশা শুধুমাত্র কিছু গতানুগতিক ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। একজন ইউটিউবার এখন একজন প্রকৌশলীর চেয়ে বেশি আয় করতে পারে। একজন পেশাদার গেমার একজন ফুটবল তারকার মতই বিখ্যাত।

Foto: Privat
 The article is written by Ratan who is a political refugee. The views are his own.

 

কিন্তু অধিকাংশ অভিবাসী পিতামাতার মানসিকতায়, যেমনটা আমি তাঁদেরকে চিনি, পেশা এখনও রয়ে গিয়েছে সেই আগের মতোই। তাঁরা আশা করেন তাঁদের সন্তানরা স্কুলে ভালো করবে এবং একটি সনাতন ধারায় ক্যারিয়ার গড়ে তুলবে।

অপ্রচলিত উপায়ে প্রায়শই ঝুঁকি থাকে, এটাকেই ভয় পান তাঁরা। কিন্তু সন্তানরা সবসময় তাঁদের সাথে একমত হয় না। পিতামাতা ও সন্তানদের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কখনো কখনো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে পারে।

দ্বন্দের আরেকটি বিষয় হতে পারে সংস্কৃতি। অভিবাসী পিতামাতা আশা করেন তাঁদের সন্তানরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে ত্যাগ করবে না। এখানেও পিতামাতা ও সন্তানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।

সন্তানের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নপূরণ
বেশীরভাগ অভিবাসীই তাদের সন্তানদের একটি ভালো ভবিষ্যতের আশা নিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমান। নতুন দেশে প্রায়শই তাদের বিলাসিতার সামর্থ্য থাকে না। শিশুদের সমস্ত চাহিদা পূরণ করতে পারেন না। তাদেরকে সবসময় যা আছে এবং তারা যা আশা করছেন তার মধ্যে সমন্বয় করে চলতে হয়। সুতরাং তাঁরা আশা করেন যে শিশুরা তাঁদের চেয়ে ভাল করবে।

অভিভাবকগণ মনে করেন স্কুলে ভাল গ্রেড এবং একটি চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি তাদের সন্তানদের নিরাপদ কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের সমাজগুলোতে বেশ বড় ধরণের সামাজিক ভাগ রয়েছে। যারা রাষ্ট্রীয় খাতে নিম্ন পদে চাকুরি করেন, তাঁদেরও অনেকে শুধু ভাল আয়ই করেন না, অন্যদের ওপর কর্তৃত্ব ফলানোর ক্ষমতাও রাখেন। এসব দেশের বেশীরভাগ বাবা-মা তাদের সন্তানদের জন্য এধরনের একটি অবস্থান প্রত্যাশা করেন। তাঁদের কাছে এটি গর্বের বিষয়। সুতরাং, কিছু পেশা সম্পর্কে তাদের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এমনকি যখন তারা একটি নতুন দেশে অভিবাসী হয়, তখনও সে-সব স্বপ্ন অপরিহার্যভাবে অদৃশ্য হয়ে যায় না। তারা তাদের সন্তানদের জন্য এমন একটি শিক্ষা বা পেশা রপ্ত করার চেষ্টা করে, যা সন্তানরা পছন্দ নাও করতে পারে।
এই প্রত্যাশা সবসময় ভালো ফলাফল দেয় না। শিশুরা ভালো করার জন্য ক্রমাগত চাপ অনুভব করতে পারে । যখন তাদের বন্ধুরা ভিডিও গেম খেলছে অথবা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই তারা পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করবে না।

এছাড়াও যে সব শিশুরা কয়েক বছরের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে নতুন দেশে এসেছে, তাদের একটি নতুন ভাষা শিখতে হয়। তাদের পক্ষে স্কুলে ভাল করা সহজ নয়, বরং এর বিপরীতটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। এই পরিস্থিতিতে একাডেমিক উৎকর্ষের জন্য উচ্চতর প্রত্যাশা শিশুদের বোঝা বাড়িয়ে দিবে।
শিশুরা হয়তো অপ্রচলিত পথে কর্মজীবনের স্বপ্ন দেখতে পারে, হয়তো তারা ডিজিটাল জগতে একজন ইউটিউবার, ব্লগার বা গেমার হিসেবে অর্থ উপার্জন করার চিন্তা করতে পারে।

সাংস্কৃতিক গুরুত্বে পার্থক্য
পিতামাতার একটি সাধারণ আকাঙ্ক্ষা যে তাদের সন্তানরা তাদের পরিবারের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বহন করবে। অভিবাসী পিতামাতার জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ, কারণ বাচ্চারা হয়তো বাবা-ময়ের মতো এটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না। এই ভার্চুয়াল গ্লোবাল ভিলেজে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোনো গুরুত্বই হয় তো তাদের কাছে নেই।
পোশাক, গান শোনা, চুল কাটা, খেলাধুলা, খাদ্য, ইত্যাদি ইস্যুতেও শিশুরা বৈশ্বিক ভার্চুয়াল প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়।

ইউটিউব, টিকটক বা ইনস্টাগ্রামের একজন তারকা তাদের জীবনে অনেক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। স্কুলের বন্ধু এবং সহপাঠীদেরকে এসকল প্রবণতা অনুসরণ করতে দেখে অভিবাসী শিশুরাও তাদেরকে অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু তাদের পিতামাতা হয়তো এটা পছন্দ নাও করতে পারে, কারণ তাদের কাছে এই প্রবণতা নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের স্বপ্নের উপর আঘাত বলে বিবেচিত হতে পারে।

অভিবাসী শিশুদের ভাষা এবং সংস্কৃতি গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখে তাদের বন্ধু-বান্ধব, বাবা-মা নয়। তারা প্রায়শই বাড়িতে পারিবারিক ভাষা ব্যবহার করতে করতে চায় না। উল্টো বাবা-মাকে অভিবাসী দেশের ভাষা ব্যবহারের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।

কিছু পিতামাতা তাদের সন্তানদেরকে নিজ দেশের ও নিজ ভাষার গান, কবিতা, ইত্যাদি শেখানোর চেষ্টা করেন, যদিও শিশুরা শব্দগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না। পিতামাতা সন্তানের আধা-সঠিক উচ্চারণকে উপভোগ করেন এবং তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সন্তানকে নিয়ে গর্বিত হন। তবে শিশুরা এটাকে চাপ হিসেবে অনুভব করতে পারে, কারণ পিতামাতার মত দেশীয় প্রথার সাথে তাদের কোনো সাংস্কৃতিক সম্পর্ক নেই। তাছাড়া শিশুদের পক্ষে তাদের বন্ধুদের কাছে এধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গল্প করা সম্ভব হয় না। কিছু শিশু তাদের পিতামাতাকে খুশি করার জন্য এসবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু সব ছেলে-মেয়েরাই যে সেরকমটা ভাববে, এমন নয়।

দ্বৈত জীবন যাপনের ঝুঁকি
অভিবাসী শিশুরা ধীরে ধীরে তাদের পিতামাতার কাছে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত খাদ্যের প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। বরং স্কুলে তাদের বন্ধুরা যা খায়, তা উপভোগ করতে শুরু করতে পারে।

এছাড়াও কিছু খাদ্য এবং পানীয় রয়েছে, যা শিশুদের পরিবারে ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত। বাবা-মা আশা করেন যে তাদের ছেলেমেয়েরা এই ধরনের খাদ্য খাবে না। কিন্তু শিশুদের কাছে খাদ্যের এমন ধর্মীয় গুরুত্বের কোনো অর্থ নাও থাকতে পারে। যখন বাবা-মা আবিষ্কার করেন যে তাঁদের সন্তানরা ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ খাবার খাচ্ছে, তখন সেটা নিয়ে পরিবারে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে সন্তান যদি কিশোর বয়সী হয়।

পোশাক আরো বড় দ্বন্দ্বের কারণ পারে, যা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। বাবা-মা যে-দেশ থেকে এসেছেন, সেখানে হয়তো কোন কিশোর সংস্কৃতি নেই। তাই যখন একটি অভিবাসী মেয়ে তুলনামূলকভাবে ছোট এবং উন্মোচিত পোশাক পরতে শুরু করে, তখন বাবা-মা এক ধরনের অসহায়তা অনুভব করেন। এটা তাঁদের কাছে মর্মান্তিক হতে পারে। পরিবারে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ বলে বিবেচনা করতে পারেন তারা। যদি পোশাকের সাথে ধর্মীয় বিষয় যুক্ত থাকে, তাহলে বাবা-মা মেয়েটিকে তিরস্কারও করতে পারেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কিছু শিশু দ্বৈত জীবন যাপন করতে শুরু করে – তারা বন্ধুমহলে একভাবে এবং পরিবারে অন্যভাবে আচরণ করা শুরু করে। পিতামাতা এবং বন্ধু উভয়ের কাছেই মিথ্যা বলা শুরু করে, যা শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক উভয় স্বাস্থ্যের জন্যই ক্ষতিকর।

ছেলে ও মেয়েতে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
অভিবাসী বাবা-মায়ের পক্ষে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সাথে একটু বেশি উদার হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বেশিরভাগ বাবা-মা এতে কিছু মনে করেন না যদি তাদের ছেলে পারিবারিক সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না এমন পোষাক, যেমন ছেঁড়া জিন্স পরতে শুরু করে কিংবা নতুন ট্রেন্ড অনুসরণ করে ভিন্নভাবে চুল কাটতে শুরু করে। এমনকি তাদের ছেলে অন্য সংস্কৃতির মেয়ের সাথে ডেটিং শুরু করলেও খুব একটা আপত্তি আসবে না। কিন্তু তাদের মেয়ে বান্ধবীদের অনুসরণ করে তার চুল রং করলেও তা মেনে নিতে সমস্যা হতে পারে, ডেটিং তো দূরের কথা।

যাই হোক, ছেলেরাও পুরো পারিবারিক সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে যদি তাদের ওপর কোনো কিছু অনুসরণ করার জন্য কঠিন চাপ দেওয়া হয়। তারা কর্তৃত্ব থেকে মুক্তির বিভ্রমের শিকার হতে পারে এবং ধ্বংসাত্মক গ্যাং দলে যোগ দিতে পারে। এর ফলে স্কুলের ফলাফল খারাপ হতে পারে এবং পরিবারের সাথে চরম সংঘাতের সৃষ্টি হতে পারে।

ইন্টিগ্রেশন ও অভিবাসী বাবা-মায়ের প্রত্যাশার দ্বন্দ্ব
পশ্চিমা দেশগুলোতে অভিবাসীদের ইন্টিগ্রেশন নিয়ে বেশ কথা হয়। অভিবাসী শিশুদের জন্য ইন্টিগ্রেশনের অর্থ হচ্ছে নতুন দেশে প্রচলিত শিশু বা কিশোর সংস্কৃতিকে অনুসরণ করা, তা সেটা যাই হোক না কেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ইন্টিগ্রেশন অভিবাসী পরিবারে পিতামাতা-সন্তানের দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেয়। জার্নাল অফ এথনিক অ্যান্ড মাইগ্রেশন স্টাডিজ ভলিউম ৪৫, ২০১৯ ইস্যু ৯, নেদারল্যান্ডে মরোক্কো এবং তুর্কি বংশোদ্ভূতদের (১৫-৪৫ বছর) মধ্যে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে অভিবাসী প্রেক্ষাপটবিহীন ব্যক্তিদের তুলনায় পিতামাতার সাথে তাদের কিছুটা বেশি দ্বন্দ্ব রয়েছে। গবেষণাটি এই উপসংহার টেনেছে যে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ইন্টিগ্রেশন পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষতি করতে পারে।

সুতরাং এটা বলা যেতে পারে যে ইন্টিগ্রেশন সবসময় পিতামাতার ইচ্ছা নয়। প্রায় প্রতিটি অভিবাসী পরিবারের পিতামাতা এবং শিশুদের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ব্যবধান রয়েছে। শিশুরা তুলনামূলকভাবে দ্রুত নতুন দেশের ভাষা, আচরণ, মনোভাব ও মূল্যবোধ শিখে ফেলে। ফলে অভিবাসী পিতামাতা ও শিশুরা ক্রমবর্ধমানহারে ভিন্ন সাংস্কৃতিক জগতে বাস করে।

সন্তানের কাছে চিয়ারলিডার হোন
ইন্টিগ্রেশন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উভয়ই শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এ দুটো প্রায়শই একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং শিশুদের পক্ষে সবকিছুর ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন। সুতরাং পিতামাতাকে তাদের প্রত্যাশা কমাতে হবে, এবং একই সাথে তাদের শেখা উচিত কীভাবে পশ্চিমা সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মূল্য দেয় ও পুরস্কৃত করে। ডিজিটাল দুনিয়া কীভাবে কাজ করে এবং শিশুদের ওপর তা কী ধরনের প্রভাব ফেলে, সেটা বাবা-মায়ের শেখা উচিত। এবং এসব কিছু মাথায় রেখে বাবা-মায়ের উচিত নিয়ন্ত্রণের বদলে প্রেরণার ওপর ভিত্তি করে কৌশল তৈরি করা।

এর জন্য বাবা-মায়ের উচিত শিশুদের ‘চিয়ারলিডার’ হওয়া, সমালোচক নয়। তাদের মনে রাখা উচিত যে অতিরিক্ত প্রত্যাশা, সমালোচনা বা অন্য শিশুর সাথে তুলনা শিশুর বিষণ্ণতার কারণ হতে পারে। শিশুদের সাথে কথোপকথনে পিতামাতার এমনভাবে প্রশ্ন করা উচিত যাতে শিশুরা সমস্যাটি উপলব্ধি করতে পারে এবং নিজেরাই সেটির সমাধান খুঁজে বের করতে পারে।